আইন ও পরামর্শবুলেটিন নিউজস্থানীয় সংবাদ

যৌন হয়রানি ও জেন্ডার ভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধ এবং প্রতিকারের করণীয়  শীর্ষক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত

নিজস্ব প্রতিবেদক : যৌন হয়রানি কার্যকরভাবে প্রতিরোধ ও এর প্রতিকার বিধানে আইনের প্রয়োজনীয়তা এবং এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে নীতি পরিবর্তন, পরিপূর্ণ আইন প্রনয়ণে এডভোকেসীর উদ্দেশ্যে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের সাথে আজ ৯ জানুয়ারি ২০২৫, সকাল ১১ থেকে দুপুর ১:৩০ মিনিট পর্যন্ত সিরডাপ অডিটোরিয়ামে “যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও প্রতিকারে করনীয়” শীর্ষক একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করে।

উক্ত সভায় আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর চেয়ার পার্সন বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট জেড. আই. খান স্বাগত বক্তব্য রাখেন।

আসক-এর জ্যেষ্ঠ সমন্বয়কারী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির সভাটি সঞ্চালনা করেন।

প্রকল্প সমন্বয়কারী আসমা খানম রুবা প্রকল্পের লক্ষ্য ও কার্যক্রম, কর্মএলাকায় যৌন হয়রানি ও জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার চিত্র, এবং যৌন হয়রানি প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের বর্তমান অবস্থার ওপর একটি উপস্থাপনা তুলে ধরেন।
তিনি জানান ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এর সহায়তায় ব্র্যাকের সংগে যৌথভাবে “AGNEE-Awareness, Actions, and Advocacy for Gender-Equal and Safe Spaces for Women and Girls ” –অগ্নি প্রকল্পের বাস্তবায়ন করছে আসক। প্রকল্পটির অধীনে গাজীপুর ও রাজশাহী জেলায় বিশেষ করে পরিবহন, বাজার স্থান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সাইবার ভিত্তিক যৌন হয়রানি এবং জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধ করে জেন্ডার সমতায়নের লক্ষ্যে ১৪ টি সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন (সিএসও) সহ সরকারি, বেসরকারি কর্মীদের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
শিক্ষাঙ্গনে এবং কর্মস্থলে নারী ও শিশুদের যৌন হয়রানি প্রতিরোধে উচ্চ আদালতের মাইলফলক রায়ের এক যুগ পার হয়ে গেছে। এ রায়ে সুষ্পষ্টভাবে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা প্রদান করা হলেও তা যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। নির্দিষ্ট আইনে রূপান্তর না হওয়া পর্যন্ত সংবিধান অনুযায়ী এ নির্দেশনা আইন হিসেবে কাজ করার কথা থাকলেও প্রায়োগিক ক্ষেত্রে তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

২০০৯ সালে যৌন হয়রানি সংক্রান্ত আদালতের নির্দেশনা পাওয়ার পরও যেহেতু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিশেষত: বিশ্ববিদ্যালয়ে) যৌন হয়রানির ঘটনা আশংকাজনকভাবে জানা যাচ্ছিল এবং ভুক্তোভোগীরা আশানুরূপ প্রতিকার পেতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারছিলো না, তাই ২১ অক্টোবর, ২০২১ তারিখে রায়টির বাস্তবায়ন চেয়ে পুনরায় হাইকোর্টে রিট দায়ের করে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) (রিট পিটিশন নং ৮৮৭৪/২০২১)। উচ্চ আদালতের দেয়া নির্দেশনা বাস্তবায়ন করে সেই অনুসারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ দেশের সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নারী ও শিশুদের যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমিটি গঠন না করায় হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পক্ষে দায়ের করা রিট আবেদনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সচিব, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ ৪০টি মন্ত্রণালয়ের সচিব, সুপ্রিম কোর্টের রেজিষ্টার জেনারেল, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে বিবাদী করা হয়। একইসঙ্গে রিট আবেদনে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নের আর্জি জানানো হয়।
এছাড়াও রায় বাস্তবায়নের একটি প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশনা চাওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং বাকীগুলোতে পর্যায় ক্রমে গঠন করা হবে মর্মে লিখিত বক্তব্য প্রদান করে।
নারী ও শিশুদের যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ও প্রতিকারে পূর্নাঙ্গ আইনের খসড়াটির বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে তিনি সুনির্দিষ্ট আ্ইন প্রণয়নে আলোচনার ভিত্তিতে অংশগ্রহনকারীদের সুপারিশ দিতে আহবান জানান।

আলোচনা সভায় তুলেন ধরেন, অগ্নি প্রকল্পের দুই কর্ম এলাকা রাজশাহী ও গাজীপুর হতে প্রাপ্ত নারীর প্রতি সহিংসতা:
রাজশাহী : বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায় রাজশাহীতে নারীর প্রতি সহিংসতা ২০২৪ সালে বিশেষ করে যৌন হয়রানি ও সহিংসতা, ধর্ষণ,পারিবারিক নির্যাতন, শিশু নির্যাতন ও যৌতুকের জন্য নির্যাতনসহ নারীর প্রতি বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।

যৌন হয়রানি ও সহিংসতা: গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে সংগৃহীত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে যৌন হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ৮৬ জন নারী। এমনকি অনলাইনরে মাধ্যমে বাড়ছে নারীর প্রতি  বৈষম্য, অবমাননা ও যৌন নপিীড়নরে ঘটনা।

ধর্ষণ ও ধর্ষনের চেষ্টা: অগ্নি প্রকল্পের তথ্য সংরক্ষণ পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২৪ সালে রাজশাহীতে ধর্ষন ও ধর্ষনের চেষ্টার শিকার হয়েছেন মোট ৪৪ জন নারী।

অপহরণ/অপহরণের চেষ্টা: ২০২৪ সালে বিভিন্ন সংবাদত্রের মাধ্যম হতে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী রাজশাহীতে অপহরণ এবং অপহরণের চেষ্টার শিকার হয়েছেন ২৮ জন বিভিন্ন বয়সের নারী।

হত্যা ও আত্মহত্যার চেষ্টা: এ বছর রাজশাহীর পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ৬৫ জন নারী বিভিন্নভাবে হত্যার শিকার হয়েছেন, বিভিন্ন কারণে আত্মহত্যা এবং আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। এদের মধ্যে একজন নারী রহস্যজনক মৃত্যুর শিকার হয়েছেন।

যৌতুকের জন্য নির্যাতন: ২০২৪ সালে যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ২৪৫ জন নারী।

স্বামীর দ্বারা মানসিক নির্যাতন: প্রকল্প এলাকায় এ বছর রাজশাহীতে কমপক্ষে ৪৩ জন নারী স্বামীর দ্বারা আর্থিক, মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। যার মধ্যে ভরণপোষণ না দেয়া, পাওনা টাকা ফেরত না দেওয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন: এ বছর রাজশাহীতে পারিবারিকভাবে স্বামী, শ্বশুরবাড়ীর লোক, প্রতিবেশী, পরিবারের লোকজনের মাধ্যমে গৃহকর্মীসহ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ৩৫১ জন নারী।

গাজীপুর : বিভিন্ন গনমাধ্যম সূত্রে জানা যায় গাজীপুরে নারীর প্রতি সহিংসতা (জানুয়ারী- ডিসেম্বর) ২০২৪ সালে বিশেষ করে যৌন হয়রানি ও সহিংসতা, ধর্ষণ, হত্যা/আত্মহত্যার চেষ্টা যৌতুকের জন্য নির্যাতন বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন নির্যাতনসহ নারীর প্রতি বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।

যৌন হয়রানি ও সহিংসতা: গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে সংগৃহীত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে যৌন হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ২১৩ জন নারী। এমনকি অনলাইনরে মাধ্যমে বাড়ছে নারীর প্রতি বষৈম্য, অবমাননা ও যৌন নপিীড়নরে ঘটনা।

ধর্ষণ ও ধর্ষনের চেষ্টা: অগ্নি প্রকল্পের তথ্য সংরক্ষণ পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২৪ সালে গাজীপুরে ধর্ষন ও ধর্ষনের চেষ্টার শিকার হয়েছেন মোট ৪২ জন নারী।

অপহরণ/অপহরণের চেষ্টা: ২০২৪ সালে বিভিন্ন সংবাদত্রের মাধ্যম হতে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী গাজীপুরে অপহরণ এবং অপহরণের চেষ্টার শিকার হয়েছেন ১৪ জন বিভিন্ন বয়সের নারী।

হত্যা ও আত্মহত্যার চেষ্টা: এ বছর গাজীপুরে পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২৫ জন নারী বিভিন্নভাবে হত্যার শিকার হয়েছেন, বিভিন্ন কারণে আত্মহত্যা এবং আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। এদের মধ্যে একজন নারী রহস্যজনক মৃত্যুর শিকার হয়েছেন।

যৌতুকের জন্য নির্যাতন: গাজীপুর জেলায় ২০২৪ সালে যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ৪০ জন নারী।

স্বামীর দ্বারা আর্থিক/মানসিক নির্যাতন: এ বছর গাজীপুরে কমপক্ষে ২৭ জন নারী স্বামীর দ্বারা আর্থিক, মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। যার মধ্যে ভরণপোষণ না দেয়া, কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ায় বাসা থেকে বের করে দেয়া, পাওনা টাকা ফেরত না দেওয়া, গায়ের রং কালো হওয়ায় মানসিক অত্যাচার ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন: এ বছর গাজীপুরে পারিবারিকভাবে স্বামী, শ্বশুরবাড়ীর লোক, প্রতিবেশী, পরিবারের লোকজনের মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ৪২৩ জন নারী।

মত বিনিময় সভার সমাপনী বক্তব্যে অ্যাড: জেড. আই. খান বলেন, নারীর প্রতি যে কোন ধরনের সহিংসতা ও বৈষম্য অগ্রহণযোগ্য। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আশা করবো গণমাধ্যম নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় বরাবরের ন্যায় সচেষ্ট থাকবে, একই সঙ্গে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর পক্ষ থেকে অঙ্গিকার থাকবে নারীর অধিকার সুরক্ষায় কার্যকর ভূমিকায় সচেষ্ট থাকার।

আলোচনায় স্থানীয় পর্যায়ে জনসচেতনতা তৈরিতে এ প্রকল্প যে ভূমিকা পালন করছে তার প্রতিফলন জাতীয় পর্যায়ে ঘটাতে সকলের সহযোগিতা কামনা করা হয়, পাশাপাশি যৌন হয়রানি ও জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতারোধে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নে সরকারের সাথে একযোগে আলোচনা চালিয়ে যাবার ওপরও জোর দেয়া হয়।

image_print
Spread the love
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments