শিক্ষাঙ্গণ

প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে শিক্ষকদের করণীয়

একটি দেশ ও জাতির অগ্রগতির মূলে রয়েছে শিক্ষা। উন্নত জাতি গঠন ও মানবসম্পদ উন্নয়নে প্রাথমিক শিক্ষার ভূমিকা অপরিসীম। সততা, নীতি, নৈতিকতা, বুদ্ধিবৃত্তিক ও মনোজাগতিক বিকাশ এবং মানবিক গুণসম্পন্ন একজন আদর্শবান মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে প্রাথমিক শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মূলত সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার বীজ হলো প্রাথমিক শিক্ষা।

আর এই শিক্ষাদানের সূচনা হয় পরিবার থেকেই। শিশুর শিক্ষার মূল বুনিয়াদ গড়ে ওঠে পারিবারিক শিক্ষার মধ্যদিয়ে। তবে শিশুর প্রাতিষ্ঠানিক তথা আনুষ্ঠানিক শিক্ষার শুরু হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গমনের মধ্য দিয়ে। প্রাথমিক শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য সকল শিশুর জন্য মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ। প্রাথমিক পর্যায়ে শিশুদের অক্ষরজ্ঞান, পঠন ও লিখন দক্ষতা এবং গাণিতিক সংখ্যার ধারণা তৈরি হয়।

বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সার্বিক উন্নয়ন ও সমন্বয় সাধনে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংবিধানের ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদের মাধ্যমে শিক্ষাকে সার্বজনীন ও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এমনকি প্রাথমিক শিক্ষা কে সার্বজনীন করতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে ৩৬ হাজারের অধিক প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করে প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রযাত্রার যে শুভ সূচনা করেছিলেন তারই ধারাবাহিকতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন। তবে করোনা মহামারী পরিস্থিতিতে প্রাথমিক শিক্ষায় ঝড়ে পড়ার হার বৃদ্ধি পেয়েছে ,শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনাগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। তাই শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়ার হার শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে এবং শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

কাজেই শিশুর শিখন দক্ষতা ও জ্ঞান অর্জনের যথার্থ কৌশল সৃষ্টি করে শিশুকে আজীবন শিক্ষার প্রতি আগ্রহী করার প্রধান দায়িত্ব একজন শিক্ষকের। প্রাথমিক অবস্থায় শিশু মনের বিকাশ ঘটাতে শিক্ষকের অবদান অপরিসীম। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের ভর্তি শতভাগ নিশ্চিত ও উপস্থিতি নিয়মিত করণের পাশাপাশি বিদ্যালয়কে শিশুদের নিকট আগ্রহী করে তুলতে শিক্ষকগণ যে সকল ভূমিকা রাখতে পারেন-

* বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ ও শ্রেণিকক্ষকে শিশু বান্ধব করে গড়ে তোলা;

* শিশুদের সুযোগ সুবিধার কথা মাথায় রেখে বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা;

* বিদ্যালয়ে পক্ষাঘাতগ্রস্ত বা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু থাকলে তাদের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা;

* বিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীর নির্ধারণ করে পর্যাপ্ত খেলার মাঠের ব্যবস্থা করা;

* শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে আন্তরিক হওয়া;

* বড়দের সম্মান করা ও ছোটদের স্নেহ করা শিখানো;

* শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিখ্যাত ব্যক্তি ও মনিষীদের নীতিকথা দেয়ালে লেখা;

* পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়ে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করা;

* শ্রেণিকক্ষ আকর্ষণীয় রং, ছবি, ফুল দ্বারা সজ্জিত করা;

* ক্ষুদে ডাক্তার, স্টুডেন্ট কাউন্সিল, ছাত্র বিগ্রেড ও কাবিং কার্যক্রম ত্বরান্বিত করা;

* শিশুকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে শ্রেণিকক্ষে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি স্থাপনের ব্যবস্থাকরণ;

* শিক্ষার্থীদেরকে অধিক শাসন না করা;

* শ্রেণিকক্ষে ডিজিটাল মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের মাধ্যমে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা;

* লেখাপড়ার পাশাপাশি শিশুদের মানসিক বিকাশেরও পর্যাপ্ত সুযোগ প্রদানের খেয়াল রাখা;

* নিয়মিতভাবে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের গল্প, আবৃত্তি, ছবি আঁকা, নাচ, গান, অভিনয়সহ নানা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড চর্চার সুযোগ প্রদান করা;

* শিক্ষার্থীদের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করা;

* শিক্ষার্থীদের শারীরিক, মানসিকসহ সকল প্রকার শাস্তিদান থেকে বিরত থাকা;

* শিক্ষার্থীদেরকে নিজের কাজ নিজে করতে উৎসাহিত করা;

* ম্যানেজিং কমিটিকে কার্যকর করা;

* অভিভাবক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে নিয়মিত অভিভাবক/মা সমাবেশের আয়োজন করা। প্রয়োজনে শিক্ষার্থীদের বাড়িতে গিয়ে/ হোম ভিজিটের মাধ্যমে তাদের বিদ্যালয়ে আসার ব্যাপারে আগ্রহী করা।

উপর্যুক্ত বিষয়সমূহ সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে ঝরে পড়ার হার শূন্যের কোঠায় চলে আসবে এবং প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিতভাবেই বৃদ্ধি পাবে।

তাছাড়া বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আন্দোলনকে সরকারের একক দায়িত্ব না ভেবে প্রত্যেক নাগরিককেই স্ব স্ব অবস্থান থেকে সোচ্চার হতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি সব ধরনের প্রচেষ্টার সম্মিলিত রূপরেখাকে বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে পারলে আজকের শিশুরাই উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে নেতৃত্ব দিবে মাথা উঁচু করে। ভবিষ্যতের বাংলাদেশ পাবে একটি আলোকিত জাতি। [লেখক : ওয়াহিদুজ্জামান, উপজেলা নির্বাহী অফিসার।]

image_print
Spread the love
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments