ঘড়ির কাঁটা সকাল ছয়টা। রুনার দিনটা শুরু হয় কপালে একফোঁটা ঘাম নিয়ে, আর শেষ হয় চোখের নিচে ক্লান্তির কালি দিয়ে। ভোর ছয়টা থেকে ভোররাত ৩টা পর্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রমে ছুটে চলা।
সকালে ছেলেদের স্কুল, স্বামীর খেদমত, ছেলেদের নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া, সবার সবকিছু ঠিকঠাক প্রোভাইট করা, কোনো কাজে ত্রুটি হলো কিনা—সব একসঙ্গে সামলে নিতে হয়।
রান্না, পরিস্কার, বাজারের লিস্ট, ইলেকট্রিসিটির বিল, ছেলেদের টিউশন ফি, স্কুলের বেতন, ওয়াই ফাই বিল, বাইরে বের হলে যাতায়াত খরচ—একটার পর একটা দায়িত্ব যেন চক্রাকারে তাকে ঘিরে রাখে।
তার ওপরে সংসারের টানাপোড়েন, চিন্তা, ক্লান্তি, কটুকথা, তিরস্কার, সন্দেহ, অবহেলা, আবদার সব মিলিয়ে জীবনটা যেন অভিশপ্ত আর বিষাদে ভরা।
তার কাজগুলো কেউ চোখে দেখে না। কেউ ভাবে না সে একা-একাই একটা পুরো সংসারের ভার বইছে। বরং যা পায়, তা হল— “ভাতটা একটু বেশি সেদ্ধ হয়েছে”, “বাচ্চার হোমওয়ার্ক খেয়াল রাখো না?”, “সারাদিন ঘরে থেকেও একটা কাজ ঠিকমতো করতে পারো না!” সারাক্ষণ কম্পিউটারে কাজ নাকি অন্য কিছু চলে তা জবাবদিহিতা।
রুনা মাথা নিচু করে নেয় সব কথা। কারণ সে জানে, প্রতিবাদ করলে সংসারে ঝড় ওঠে। তবু তার চোখের কোণে একরকম নিরব শক্তি জমে থাকে—একটা কষ্টে লেপা স্বপ্ন।
কারণ রুনা শুধুই গৃহিণী না। সে একজন সৃষ্টিশীল মানুষ।
সবাই যখন ঘুমায়—স্বামী পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে, সন্তান চোখ বন্ধ করে স্বপ্ন দেখে, তখন রুনা জেগে থাকে।
আলোর নিচে একা বসে, কম্পিউটার স্ক্রিনে তার আঙুল ছুটে চলে। সে অ্যানিমেশন তৈরি করে। কখনো নিজের ভাবনায় আঁকে ছোট্ট একটি মেয়ে—যার পিঠে ডানা আছে, কখনো বানায় এক জাদুর জগত—যেখানে মেয়েরা কেবল রান্না করে না, রাজত্বও করে।
রাত তিনটায় যখন চোখে ঘুম ভর করে, তখনো সে বলে, “আরেকটা সিকোয়েন্স শেষ করি।” একদিন তার তৈরি করা গল্পে, অন্য মেয়েরা সাহস পাবে—এই আশায় সে রাত জাগে।
সে জানে না, তার এই পরিশ্রম কোনোদিন স্বীকৃতি পাবে কিনা। তার স্বামী বলে, “এগুলো নেশা হয়ে গেছে তোমার, কাজের কিছু তো বের হয় না।” শাশুড়ি ভাবে, “মেয়েরা আবার কম্পিউটারে বসে কি করে রাত জাগে?”
তবু রুনা থামে না। কারণ সে জানে, তার স্বপ্নটা কেবল তার নিজের নয়। আরও অনেক অবহেলিত নারীর না বলা গল্প সে একদিন বলে উঠবে তার অ্যানিমেশনে, তার ছবিতে।
তবে হ্যাঁ, ক্লান্ত লাগে তারও। রাতের নির্জনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে ভাবে— “এই কি তবে জীবন? সারাদিন অন্যদের জন্য, আর রাত জেগে নিজের জন্য?” তবু সে হাসে, নিঃশব্দে।
কারণ সে জানে, সে কেবল সংসারের বাতি না, সে একটা দীপ। যে নিজে জ্বলে, অন্যদের আলো দেয়।
এই রুনা—সে ‘অভিমানিনী’। যার অভিমান শক্তি হয়ে যায়। যার নিঃশব্দ লড়াই একদিন গল্প হয়ে উঠবে—অসংখ্য মেয়ের অনুপ্রেরণা হবে।
হয়তো সেদিন সে আর থাকবে না এই পৃথিবীতে। তবুও সবাই দিব্যি খুশিতে দিন কাটাবে, একেবারের জন্যও মনে পড়বেনা সংসারে তার কতটা অবদান ছিলো। তবে সে জানে তার সৃষ্টি একদিন তার মতো অবহেলিতদের প্রেরণার প্রধান হাতিয়ার হয়ে জ্বলে উঠবে। রুনা স্বপ্ন দেখে তার সন্তানেরা একদিন জ্বলজ্বল করবে বিশ্বময়, তা-ই তো তার এত ত্যাগ আর তিতিক্ষার পথচলা।
আসল সুখ আর আনন্দ উপভোগ করবে সেদিন, বুক ফুলিয়ে আল্লাহর কাছে দু হাত তুলে খুশিতে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলবে, তোমার ভালোবাসা ছিলো বলেই আমার ছেলেরা উজ্জ্বল নক্ষত্র।
“আমি শুধুই রান্নাঘরের রুনা নই, আমি সেই মেয়েটি— যে আঁধারেও স্বপ্ন দেখে, যে ক্লান্ত শরীর নিয়ে লড়াই করে, যে চুপচাপ পথ হাঁটে, কিন্তু থামে না— আমি অভিমানিনী, আমি আলো হয়ে উঠব।”
লেখক পরিচিতি-
কবি খাদিজা আক্তার মিলি। তিনি ১৯৮৫ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। কবি মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হন।বাবা আব্দুল মান্নান খান। মা জরিনা বেগম।কবি মোড়েলগন্জ এস এম কলেজ থেকে বি বি এস স্নাতক পাস করেন। তিঁনি তার অবসর সময়ে লেখালেখি করেন। কবি বুলেটিন নিউজে নিয়মিত লেখেন। তিনি অসংখ্য সাহিত্য সম্মাননা অর্জন করেছেন।