সাহিত্য আসর

ছোট গল্প “অনুভুতির চুপকথা”

প্রায় দুই ঘণ্টার টানা মুষলধারে বৃষ্টির পর আকাশ ধীরে ধীরে পরিস্কার হলো। মেঘের চাদর সরিয়ে রোদ ঝলমল করে উঠল শহরের বুকে। চারদিকে বৃষ্টিস্নাত সতেজতার ছোঁয়া—রাস্তার গাছপালা যেন আরও সবুজ, বাতাসে এক ধরনের মাটির সোঁদা গন্ধ। এমন মোহময় পরিবেশে ঘরে বসে থাকা যায়? মায়ের বারণ উপেক্ষা করেই বেরিয়ে পড়লাম। শহরের কংক্রিটের দেয়াল পেরিয়ে গাছপালায় ঘেরা কোনো এক পার্কের দিকে হাঁটতে থাকলাম, বৃষ্টির ফোঁটায় ভেজা পাতা মাড়িয়ে, স্নিগ্ধ বাতাস গায়ে মেখে।

পার্কের মধ্যে সরু রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। রাস্তার দুই পাশে নাম না জানা গাছের সারি৷ মাঝে মাঝে হাওয়ার ঝাপটায় গাছের পাতা থেকে পানি ঝরে পড়ছে৷ জায়গাটা এখনো বেশ নীরব৷ বৃষ্টির কারনে মানুষের আনাগোনা নেই বললেই চলে। পাখির কিচির মিচির ডাকে পুরো পার্ক মুখরিত৷ মনে হচ্ছে যেন তারাও আমার সাথে প্রকৃতি দেখতে বেরিয়েছে৷ কংক্রিটের ভেজা রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটতে বেশ লাগছে। আজ বেশ ভালোই বৃষ্টি হয়েছে ।

হঠাৎ কানে ভেসে এলো এক পরিচিত কণ্ঠস্বর। মনে হলো, এই স্বর আমি আগেও শুনেছি—অনেকবার। হৃদয়ের কোথাও যেন এক মুহূর্তে দোলা লাগল। চারপাশে তাকিয়ে খানিকটা খুঁজে দেখলাম, আর ঠিক তখনই নিশ্চিত হলাম—আমার অনুমান সত্যি! এটা শুভ্র!

শুভ্রকে দেখলাম একটা গাছের নিচে বসে আছে। তার হাতে একটা ছোট্ট ভেজা পাখি, যেটা হয়তো এখনও বৃষ্টির ঝাপটা সামলে নিতে পারছে না। সে আলতো করে পাখিটাকে ধরে কিছু বলছে, যেন বুঝিয়ে দিচ্ছে, “ভয় নেই, সব ঠিক হয়ে যাবে।” কেউ দেখলে অবাক হতে পারে—একজন মানুষ পাখির সাথে কথোপকথনে এতটা মগ্ন! কিন্তু আমি অবাক হলাম না।

আমি জানি শুভ্র এমনই। না… ‘জানি’ বলাটা ঠিক হবে না। জানতাম! এক বছর আগে আমি এই মানুষটাকে খুব ভালোভাবেই চিনতাম। কিন্তু এখন?

থাক… পুরোনো গল্প এখন আর টেনে কী লাভ?

আমি নিঃশব্দে শুভ্রর পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

— কী হয়েছে ওর?

— এইতো, বৃষ্টিতে বাসা ভেঙে পড়ে গেছে, পাখাটাও ভেঙে গেছে… কে?!

— আমি! এত অবাক হওয়ার কিছু নেই।

— তুমি?! তুমি এখানে, এই সময়?

— কেন, আসতে পারি না? আপনি একাই বুঝি প্রকৃতিকে ভালোবাসেন?

— উফ্ বাবা! এখনো কথার সেই একই সুর, একই ঝাঁজ! একটুও বদলাওনি, দেখছি।

— সে তো আপনিও নন! এখনো মানুষ ছেড়ে পশুপাখির সাথে কথা বলেন!

— হুম! মানুষ ছোট হলে কী হবে, ঝগড়ার দক্ষতা কিন্তু দারুণ!

— শুনুন! একদম আমাকে ছোট বলবেন না! আর ওরা তো আপনার কথা বোঝেও না, উত্তরও দেয় না, তবুও কেন এত কথা বলেন বলুন তো?

— কেন বলি! ওহ্, তুমি এখন বুঝবে না। আরেকটু বড় হও, তখন বুঝবে।

— আমি বড় হয়ে গেছি!

— বড় যে হওনি, সেটা তো এই কথাতেই বোঝা গেল। সত্যিকারের বড়রা কখনো বড় হতে চায় না।

— আপনি…

— নদীর পাড়ে যাবে?

— আপনি নিয়ে যাবেন?

— হ্যাঁ, চলো।

(শুভ্র আমার থেকে মাত্র ৪ বছরের বড়ো। তবুও ওর মনে হয় আমি যেন ওর থেকে কত ছোট৷ খুব অদ্ভুত ভাবে পরিচয় হয়েছিলো আমাদের।

এইচএসসি পরিক্ষায় ভালো রেজাল্ট করায় বাবা বলেছিলো আমি যা চাইবো তাই দেবে। তখন আমি বায়না ধরেছিলাম একটা কথা বলা পাখির জন্য। সেদিন বিকেলেই বাবা আমাকে পাখির দোকানে নিয়ে গেলেন৷ অনেকগুলো পাখি দেখার পর অবশেষে আমার একটা টিয়া পাখি পছন্দ হলো৷ সুন্দর কারুকার্যের একটা খাচায় পাখিটা নিয়ে ফিরে আসার সময় একটা ছেলে সাথে বাবার কথায় হয়। ছেলেটি বাবাকে সালাম দিয়ে বললো, “আংকেল আমি আপনাদের কথপোকথন শুনেছি৷ ভালো রেজাল্ট করার জন্য মেয়ে খাচায় বন্দী পাখি উপহার না দিয়ে৷ এই পাখির মুক্ত জীবন টা তাকে উপহার দিন। “

ব্যস বাবাও তার কথায় প্রভাবিত হয়ে আমার শখের পাখিটা উড়িয়ে দিলো। প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে বাসায় ফিরে ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিলাম। কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতেই পারিনি। ঘুম থেকে উঠে ফোনটা নিয়ে ফেসবুকে ঢুকতেই ফ্রেন্ড সাজেশনে সেই ছেলের ছবি। আমার চিনতে একটুও অসুবিধা হলোনা৷

তখন তো বাবার জন্য কিচ্ছু বলতে পারিনি৷ কিন্তু এবার আর সুযোগ ছাড়লাম না৷ আইডিতে ঢুকে মেসেজ অপশনে ক্লিক করে ইচ্ছে মতো কথা যা-তা লিখে সেন্ড করে দিলাম।

ঘন্টা খানিক পরেই রিপ্লাই আসলো, “তোমাকে যদি একটা ঘরের মধ্যে একটানা ৭দিন বন্ধ করে রেখে দেওয়া হয় তখন তোমার যেমন লাগবে তোমার যত কষ্ট হবে, ওই পাখিটারও ঠিক তেমন লাগবে ততটায় কষ্ট হবে৷“

তারপর অনেক টা সময় শুভ্রর সাথে আমার কথা হলো। খুব সুন্দর করে আমাকে বোঝালো। আমিও লক্ষি মেয়ের মতো বুঝলাম। তারপর ভালো, মন্দ, খুনসুটি, দুষ্টুমি সব মিলিয়ে দেখতে দেখতে ২টা বছর কেটে গেলো। ওর সংস্পর্শে থেকে আমিও দারুন প্রকৃতিপ্রেমী হয়ে উঠলাম।

শুভ্রর অসাধারন বাচনভঙ্গি আর দারুন লেখনী আমাকে ক্রমাগত ওর প্রতি আকর্ষণ করতে লাগলো৷ নিজের অজান্তেই প্রচন্ড রকমের ভালোবেসে ফেললাম৷

কিন্তু আমার এই ভালোবাসা শুভ্রর হৃদয় স্পর্শ করতে পারলোনা। আমার হৃদয়ের ব্যাকুলতা ওকে অনুভব করাতে গিয়েও আমি বার বার ব্যর্থ হলাম।

অবশেষে একটু একটু করে দুরত্ব বাড়িয়ে দিলাম৷ আমি চাইনি তিক্ততা দিয়ে আমাদের দুরত্ব বাড়ুক, আমি চেয়েছিলাম এমন ভাবে আমাদের মাঝে দুরত্ব তৈরি হোক যেন হটাৎ কখনো কোনো রাস্তার বাঁকে দেখা হয়ে গেলে অন্তত এক কাপ চা খেতে পারি। হাসি মুখে জিজ্ঞেস করতে পারি “কেমন আছো।”

অবশ্য হলোও ঠিক তেমন। ১বছর পর আজ আবার আমরা মুখোমুখি৷)

সূর্য লাল আভা ধারণ করে পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। নদীর পানিতে সূর্যের প্রতিচ্ছবি ঢেউয়ের সাথে কেঁপে কেঁপে উঠছে। পাখিরা নীড়ে ফিরছে, তাদের ছায়া মিশে যাচ্ছে পানির বুকে। মাঝে মাঝে শীতল বাতাস গায়ে এসে লাগছে, হালকা শিরশিরে অনুভূতি জাগিয়ে।

নীরবতা নেমে এসেছিল আমাদের মাঝে। আমি তাকিয়ে রইলাম নদীর পানে, শুভ্র উড়ন্ত পাখির দিকে।

আমি নিরবতা ভেঙে প্রশ্ন করলাম—
— আপনি খুব পাখি ভালোবাসেন, তাই না?

শুভ্র এক মুহূর্ত থেমে বলল—
— হ্যাঁ।

আমি একটু হাসলাম। কেমন যেন এক গভীর অনুভূতি ছুঁয়ে গেল আমাকে।

– আচ্ছা জানেন, কখনো কখনো মনে হয়, আপনার আসলে আকাশের নিচে মাটিতে মানুষ নয়, পাখি হয়ে জন্মানো উচিত ছিল। চাতক পাখি হয়ে।

— চাতক পাখি! চাতক পাখি কেন?

আমি উত্তর দিলাম না, শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সূর্য প্রায় ডুবে গেছে, আকাশের শেষ আলো মিশে যাচ্ছে অন্ধকারের সাথে।

(লেখক সুমি কায়সারের এমন নিয়মিত লেখা পেতে চোখ রাখুন বুলেটিন নিউজ২৪. কমে)

 

লেখক পরিচিতি-
লেখক সুমি কায়সার
রাজশাহী জেলা বাগমারা উপজেলা হরিপুর গ্রামে
২১শে সেপ্টেম্বর ২০০৩ সালে এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন পিতা: মো: শাফিকুল ইসলাম মাতা: মোছা: নাসিমা। লেখক একজন নিয়মিত ছাত্রী। তাঁর
উপন্যাসের প্রতি তীব্র আবেগ থেকেই লেখার প্রতি আগ্রহ। তিনি বুলেটিন নিউজ ও ভোরের পাতায় নিয়মিত লেখালেখি করে থাকেন। 

image_print
Spread the love
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments