একুশে পদকপ্রাপ্ত মোঃ জিয়াউল হক এক অনন্য দৃষ্টান্ত
তাকে দেখতে অনেকে তার বাড়িতে যাচ্ছে। কিন্তু সকাল থেকে তিনি বাড়িতে নেই। তিনি দই বিক্রি করতে বের হয়েছেন বাহিরে। ৯০ বছর বয়সেও তাকে কাজ করে খেতে হচ্ছে। এমন মানুষ পৃথিবীতে আছে ভাবা যায়!
তিনি একজন অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব। জন্মসূত্রে অত্যন্ত মেধাবী সত্ত্বেও পরিবারের অসচ্ছলতার কারণে ছোটবেলা থেকেই স্কুলে যাওয়ার পরিবর্তে জীবন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে বাধ্য হন তিনি।
১৯৫৫ সালে পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর টাকার অভাবে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায় তার। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন তিনি। শুরু করেন দইয়ের ব্যবসা। এরপর সংসারের কিছুটা সচ্ছলতা ফিরে এলে দই বিক্রির লভ্যাংশের টাকা দিয়ে গরীব, অসহায় ও পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি গরীব, অসহায় শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে বই বিতরণ কার্যক্রম শুরু করেন।
তার হাতে টাকা জমলেই তিনি গরীব ছাত্রছাত্রীদের বই কেনার ব্যবস্থা করে দিতেন। এভাবে অসংখ্য মানুষ তার নিকট থেকে উপকৃত হয়। তার দেওয়া বই পেয়ে অনেকে অনার্স, মাস্টার্স পর্যন্ত করেছে। নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে তারা। অনেক অসহায় নারীকে তিনি বাড়ি পর্যন্ত করে দিয়েছেন।
তিনি ১৯৬৯ সাল থেকে তিল তিল করে গড়ে তোলেন তাঁর পারিবারিক লাইব্রেরি। এরপর প্রতিষ্ঠা করেন ‘জিয়াউল হক সাধারণ পাঠাগার’। তার পাঠাগারে বইয়ের সংখ্যা ১৪০০০! পাঠাগারে পাঠ্যবই বাদেও অনেক গল্প, উপন্যাস, বিভিন্ন প্রবন্ধের বই রয়েছে। কী সুন্দর চিন্তাভাবনা তার!
তিনি বলেন, “শুধু পাঠ্য বই পড়ে ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞান অর্জন হবে না মনে করেই আমি নিজের নামে সাধারণ পাঠাগার স্থাপন করেছি।”
একজন সাধারণ মানুষ হয়েও নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা ও মানবসেবায় ব্রতী হয়ে যে অসাধারণ চিন্তা করেছেন তা এ সমাজে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তাঁর এমন মহৎ কাজ দেখে আগ্রহী হয়ে পরবর্তীকালে বিত্তবান ও শিক্ষানুরাগী সুধীজন অনুদান প্রদানের জন্য এগিয়ে আসেন।
তাঁর বুদ্ধিমত্তা, সৃজনশীল মননের বিকাশ এবং ইচ্ছাশক্তি দেখে ২০০৬ সালে ইউনিলিভার বাংলাদেশ কর্তৃক ‘সাদামনের মানুষ স্বর্ণপদক-২০০৬’এবং শিক্ষা ও মানবসেবায় অসামান্য অবদানের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কর্তৃক তাঁকে সম্মাননা-২০১৪ প্রদান করা হয়।
তিনি দারিদ্র্যের সঙ্গে আজীবন লড়াই করে নিরবচ্ছিন্নভাবে সমাজসেবা করে যাচ্ছেন। তাঁর এই সমাজসেবামূলক কর্মের জন্য তিনি এলাকায় বিশেষভাবে সুপরিচিত।
সমাজসেবায় গৌরবোজ্জ্বল অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মোঃ জিয়াউল হককে ২০২৪ সালের ‘একুশে পদক’-এ ভূষিত করা হয়। তিনি দেশের জন্য যে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন তা নজীরবিহীন। তিনি দেশের গর্ব, দেশের সম্পদ। তার নিকট থেকে একটি শিক্ষানীয় বিষয় জন্ম হলো আজ। [মো. মনজুরুল ইসলাম (মনজু) ও তথ্যসূত্র-সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক পদকপ্রাপ্ত কৃতীজনদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি]